হিমঘর - ছোটগল্প

সরকারি হাসপাতালের সাধারণ কেবিন। চারদিকে এন্টিসেপ্‌টিকের গন্ধ। আহহ! গন্ধটা কত্তো প্রিয় ছিল আমার। চারিদিকে নানারকম অসুস্থতা নিয়ে এখানে আসা নানারকম মানুষ। সাথে আছে তাদের আত্মীয় স্বজনের কোলাহল। আমি অবশ্য কোনোকালেই এত কোলাহল পছন্দ করতাম না। মানুষ অপ্রয়োজনীয় কথা বলে এতো এনার্জি খরচ করার পরও 'রিফ্রেশড' হয় কীভাবে, কে জানে!

এ কদিন আমি যে বেডটায় শুয়ে ছিলাম, সেই বেডে নতুন অতিথি এসেছে। সত্যিই, হাসপাতালে সবাই অতিথি। রোগবালাই কোনো তিথি-পর্ব মেনে আসেনা। বেডের সামনে ডাক্তার এলেন। রোগীর স্বজনকে ডেকে বললেন, "সাডেন হার্ট ফেইলিওর। এখানে সরকারি হাসপাতালে এর চিকিৎসা হবেনা। আমার চেম্বারে আসুন। দারুণ টেস্ট ফ্যাসিলিটি আছে। জার্মানি থেকে আনা টেস্ট কিট, সুইডেনের আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন, ইংল্যান্ডের টেস্ট ফ্যাসিলিটি! চমৎকার!" রোগীর স্বজন এতো মানসিক চাপের মাঝে সেই ডাক্তারের চেম্বারের কোন টেকনোলজি কোন দেশের, আঁচ করতে পারলেন না। ডাক্তারের ব্যবসায়িক প্রচারণা বৃথাই গেলো। স্বজন বললেন, 

"স্যার, কেমন খরচ হতে পারে?"

"লাখ খানেক তো হবেই। তিন লাখ টাকা বাজেটে রাখুন।"

"কিন্তু স্যার, একটু কমে যদি… আমরা আর্থিকভাবে…"

"ইন্সুইরেন্স আছে?"

"এইতো স্যার। কার্ডটা মনে করে সাথে এনেছিলাম স্যার। দেখুন তো কাজ হবে কিনা স্যার"

"এটা এতো বড় খরচ কাভার করবেনা। পুরো খরচ আপনাকেই বইতে হবে।"

"কিন্তু স্যার…"

"আমি চলি এখন। জরুরি কাজ আছে।"

লক্ষ্য করলাম, ডাক্তারসাহেব ব্যাপক একঘেয়েমি স্বরে কথা বললেন পুরো সময়টা। স্বাভাবিক, প্রতিমাসে শত শত অসহায় মানুষকে এইসব তথ্য দিতে দিতে একদিন এসে কথার মাঝে ইমোশন কাজ করেনা আর।

ডাক্তারসাহেব এতোক্ষণে অপারেশন থিয়েটারে পৌঁছে গিয়েছেন। অন্য একজন পেশেন্টের এখন-তখন অবস্থা। চিকিৎসক দলের লিডার ডাক্তারসাহেব না আসায় অপারেশন এতোক্ষণ শুরু করা যায়নি। এখন শুরু হচ্ছে।

অপারেশন থিয়েটারের বিপ বিপ সাউন্ড। ভয়াবহ। মাথাটা ঝিম ধরে আসছে আমার। ডাক্তারসাহেব অস্ত্রোপচার লিড দিচ্ছেন, সাথে নতুন একজন ইন্টার্নকে অপারেশন থিয়েটারের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

অপারেশন ব্যার্থভাবে সম্পন্ন। রোগীকে বাঁচানো যায়নি। ডাক্তারসাহেব রোগীর স্বজনদের গম্ভীর সুরে জানালেন, "স্যরি। হি ইজ নো মোর।" আঁচ করতে পারলাম, গাম্ভীর্যটা কৃত্তিম।

স্বজনরা আহাজারি করছে। মৃত মানুষটাকে নিয়ে কার কতো স্মৃতি! কার কতো আশা! ইমোশনহীন আমিও তাদের আহাজারি দেখে নিজের মনকে ভারি হতে দেখলাম।

এদিকে চিকিৎসকদল বিশ্রামাগারে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কারো মুখে কোনো দুঃখের ছোপ নেই। কেউ টিকটক স্ক্রল করছেন, কেউ কেউ আবার দলবেঁধে গানের কলি খেলছেন। মনেই হচ্ছেনা, একটু আগেই তাদের চোখের সামনে একজন মানুষ মারা গিয়েছে। কষ্ট পাচ্ছে শুধু সেই নতুন ইন্টার্নটা। ডাক্তারসাহেব বুঝতে পেরে বললেন, "দেখো সায়মা, দিস ইজ আওয়ার প্রোফেশান! এখানে ইমোশন চলেনা। একটা অপারেশন ব্যার্থ হওয়ায় ভেঙে পড়লে দিনের বাকি অপারেশনগুলো সাক্সেসফুল করবে কীভাবে?"

হঠাৎ করে আমি আশেপাশে আমার নাম শুনতে পেলাম। ওইতো, একজন নার্স বলছেন, "মিস্টার তুর্যর পরিবারের লোক কে?"

আমার ভাইয়া বললো, "আমি। ওর বড়ভাই।"

নার্স: লাশটা কি আজই বাসায় নিয়ে যাবেন?

ভাইয়া: একটু সময় দিন আমাদের। আমি বাকিসবার সাথে আলোচনা করে জানাচ্ছি।

নার্স: ঠিক আছে, রিসেপশনে আছি আমি।


ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার দেহের বেশ কয়েকটা নতুন নাম হয়েছে। লাশ, ডেডবডি, মৃতদেহ আরো কত কী! কেউ আর আমাকে তুর্য নামে ডাকছে না। ভাইয়াও না। যাই, ওদিকে আমার দেহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। শুনে আসি।

আব্বু: এতো রাতে ডেডবডি বাসায় নিয়ে গেলে সারারাতে পঁচে যাবে। দুর্গন্ধ বেরোবে।

চাচা: তাহলে আজ রাতটুকু লাশটা হিমঘরে রাখা যাক? বরফে থাকবে, তাজা থাকবে। কী বলো?

আপু: কিন্তু… তুর্যকে ছাড়া… আমি কিছুই চিন্তা করতে পারছিনা।

ভাইয়া: ঠিক আছে, আব্বু। আমি তাহলে ওনাদেরকে লাশটা মর্গে রাখার কথা বলে দিই। সাথে বাসায় আম্মুকেও জানিয়ে দিই কথাটা।

আব্বু: কাল সকালের জন্য ট্রাক ভাড়া করতে হবে। ডেডবডি ঢাকা থেকে বগুড়া নিয়ে যেতে হবে। খরচ কেমন পড়তে পারে?

চাচা: আমার চেনা ট্রাকের দালাল আছে। ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমি সামাল দিচ্ছি এদিকটা।


আমার দেহকে হিমঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু তারা জানে না, আমার মন এখনো হিম হয়ে আছে। তবুও, হিমঘরে যাচ্ছি…


❝হিমঘর❞

-হিমেল



Comments