রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু ছিলেন না!

হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিলেন না। তিনি যে ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন, তা ছিলো হিন্দুধর্ম থেকে বেশ আলাদা। কি, বিশ্বাস হচ্ছেনা? শুধু আপনি নন, প্রথম শোনায় এই তথ্য আরও অনেকেই বিশ্বাস করতে চাননি। এই আর্টিকেল পড়তে থাকুন, আপনার মনে থাকা অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পেয়ে যাবেন।




আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী। এই লেখা প্রকাশ করার জন্য আজকের চেয়ে ভালো সময় বোধহয় খুঁজে পাওয়া কঠিন। মূল টপিকে যাওয়ার আগে আমাদের কয়েকটা বিষয় জেনে নেওয়া জরুরি। একদম বেসিক। আশাকরছি আপনি আগে থেকেই জানেন। এক, রবীন্দ্রনাথ যে বাড়িতে তার জীবনের সিংহভাগ কাটিয়েছেন, সেই বাড়ির নাম ঠাকুরবাড়ি। দুই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবার নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিন, এই আর্টিকেলে যে সময়কালের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তা ১৮০০ সালের পর পরের ঘটনা। তো, চলুন মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক।

[?] কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন কবিগুরু?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম সমাজের অংশ ছিলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই নন, ঠাকুর পরিবারের আরও অনেকেই সেসময় ব্রাহ্ম সমাজের নিয়মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।


[?] ব্রাহ্ম সমাজ সম্পর্কে বিস্তারিত

ব্রাহ্ম সমাজ [Brahmo Samaj] প্রকৃতপক্ষে একটা ধর্মীয় এবং সামাজিক আন্দোলনের নাম। রাজা রামমোহন রায় এর গোড়াপত্তন করেছেন, আমরা সাধারণ জ্ঞান বইয়ে এই তথ্য দেখেছি। রাজা রামমোহন রায়ের সময়ে হিন্দুধর্ম ছিলো কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং জাতিগত বৈষম্যে ভরপুর। (এই বৈষম্য এখনও আছে। তবে তখনকার চেয়ে কম)। আবার হিন্দুধর্মের বেশ কিছু দলিলে একেশ্বরবাদীতার কথা বলা হলেও, হিন্দুধর্মকে বহু-ঈশ্বর-উপসক ধর্ম বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত, ২০২৩ সালে এসেও। অভ্যন্তরীন নানা কারণে এমনিতেই সেসময়ের হিন্দু সমাজে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিলো। সতীদাহ, বহুবিবাহ, কৌলিন্য প্রথা, জাতিভেদ, ব্রাহ্মণদের ধাপট, সুদ্রের কান্না - আপনি নাম বলে যান। তারওপর, খ্রিষ্টান মিশনারিরা ব্রিটিশ সরকারের ছায়াতলে ফুলে ফেপে উঠতে শুরু করে সেসময়। হিন্দুধর্মের এসব কুসংস্কার, ফাঁকফোকর এবং অনৈতিকতা নিয়ে ব্যাঙ্গ করতে শুরু করে সাধারণ মানুষদের। বাংলার গ্রামে গ্রামে চলে নিরক্ষর ভালা-ভোলা মানুষদের খ্রিষ্টান ধর্মে রূপান্তর করার মহাযজ্ঞ। হিন্দু সমাজ যখন ভেঙে পড়ার একদম অন্তিম পর্যায়ে, ঠিক সেসময়, ১৮২৮ সালে এসে রাজা রামমোহন রায় একটি নতুন, নিরপেক্ষ এবং সর্বজনীন ধর্মের প্রয়োজন অনুভব করতে শুরু করেন। কয়েকজন সমমনা মানুষকে নিয়ে গঠন করেন একটি একেশ্বরবাদী সমাজ, যার নাম ব্রাহ্ম সমাজ।


[?] ব্রাহ্ম সমাজ তো হিন্দু ধর্মের একটি শাখা, তাইনা? তাহলে এসে আলাদা ধর্ম বলা হচ্ছে কেন?

বেশ। ব্রাহ্ম সমাজ, হিন্দু ধর্ম থেকে সম্পুর্ণ আলাদা - এই কথা ব্রাহ্ম সমাজের অনুসারীদের মুখেই শোনা যায়। তারা নিজেদেরকে হিন্দু বলে পরিচয় দেয়না। এছাড়াও তাদের ধর্মবিশ্বাস হিন্দুদের চেয়ে অনেক আলাদা।

[এখানে আরেকটা বিষয় গুরুত্বপুর্ণ, 'ব্রাহ্ম' আর 'ব্রাহ্মণ' দুটো সম্পুর্ণ ভিন্নার্থক শব্দ। হিন্দুদের একটি অংশের নাম ব্রাহ্মণ।]


[?] হিন্দুধর্ম এবং ব্রাহ্ম সমাজের মাঝে পার্থক্য কী?

এক, হিন্দুধর্মে 'একেশ্বরবাদী' চিন্তাচেতনার কথা শুধু পুস্তকেই আছে। কিন্তু, ব্রাহ্ম সমাজের মানুষরা এক ব্রহ্মের উপাসনা করেন। বিশ্বাস করেন, তিনি নিরাকার, তাকে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব। ব্রাহ্মদের মাঝে কোনো দেব-দেবী নেই।

দুই, হিন্দুধর্মে বর্ণভেদ আছে। ব্রাহ্মণদের দাপট আছে। সুদ্রের মনে চেপে থাকা কষ্ট আছে। ব্রাহ্ম সমাজে তা নেই। তাদের সমাজে সবাই সমান।

তিন, হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ। সাথে আছে উপনিষদ, পুরাণ, গীতা। তবে ব্রাহ্ম সমাজ পুরোটাই 'বেদান্ত' এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। মনে রাখতে হবে, বেদ আর বেদান্ত এক নয়। ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যরা উপনিষদ, পুরানগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ সেসব তাদের চিন্তাধারার সাথে মেলেনা।

চার, যারা নিজেরাই নিজেদেরকে হিন্দু বলে পরিচয় দবতে চায়না, তারা হিন্দু হবে না কোনোভাবেই।


[?] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম সমাজে যুক্ত হলেন কীভাবে?

১৮৩৩ সালে, রাজা রামমোহন রায় যখন মারা যান, তখন 'ব্রাহ্ম সমাজ' নামের এই ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলন প্রায় থেমে গিয়েছিলো। রামমোহনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ব্রাহ্ম সমাজের প্রচার-প্রচারণা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিজে হাতে তুলে নেন। এভাবেই ঠাকুর পরিবারে প্রবেশ করে ব্রাহ্ম সমাজ। প্রভাবিত করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও।


[?] এখন ব্রাহ্ম সমাজের কোনো অস্তিত্ব আছে কি?

হ্যাঁ, আছে। তবে সংখ্যায় তা খুব কম। ব্রাহ্ম সমাজের অনেক অনুসারীরাই কয়েক পুরুষ পর হিন্দুধর্মে ফিরে গিয়েছিলেন। ঢাকার পাটুয়াটুলিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ব্রাহ্ম সমাজের একটা কার্যালয় আছে। নিয়মিত সেখানে ব্রাহ্ম সমাজের অনুসারীরা উপাসনার জন্য যান।


অনেকেই কবিগুরুকে পৌত্তলিক হিন্দু বলে ভুল করি আমরা। অথচ তিনি ব্রাহ্ম আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা একজন মানুষ ছিলেন। হিন্দুদের সাথে ব্রাহ্মদের ছিলো প্রত্যক্ষ রেশারেশি।

ঠাকুরবাড়িতেও ব্রাহ্ম ধর্ম বেশিদিন টেকেনি। মাত্র কয়েক পুরুষ পরই ঠাকুর পরিবার আবারও হিন্দু ধর্মে ফিরে গিয়েছিলো।

আমার এই আর্টিকেলের বেশ কিছু তথ্য উইকিপিডিয়ার সাথে মিলবে না। সেখানে ব্রাহ্মদেরকে হিন্দুধর্মের অনুসারী বলা হয়েছে। তবে, ব্রাহ্মদের দলিল এবং অন্যান্য সব জায়গায় ব্রাহ্ম সমাজকে আলাদা ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা এটাও জানি যে, তথ্যের জন্য উইকিপিডিয়া কোনো নির্ভরযোগ্য উৎস নয়।


📌 এই আর্টিকেলের সাথে সম্পর্কযুক্ত কিছু লিংক।

(১) রবীন্দ্রনাথের ধর্মমত নিয়ে লেখা চমৎকার আর্টিকেল

(২) ব্রাহ্ম সমাজের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট

(৩) ব্রাহ্ম সমাজ নিয়ে উইকিপিডিয়া পেজ

(৪) ঢাকার ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির

Comments